এখনো এক অন্য রকম যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন ওবামার



শিকাগো শহর বারাক ওবামার জন্মস্থান নয়, তবে এটি তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের কেন্দ্রভূমি। ছাত্রজীবন শেষে এখানেই তিনি ‘কমিউনিটি অর্গানাইজার’ হিসেবে রাজনীতির প্রথম পাঠ নেন। এই শহর থেকেই তিনি অঙ্গরাজ্যের আইন পরিষদে সিনেটর ও যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার সিনেটর নির্বাচিত হয়েছিলেন। আট বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে এই শহরে হাজারো মানুষের উৎফুল্ল করতালির মধ্যে ওবামা ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরাই সেই পরিবর্তন, যার অপেক্ষায় আমরা ছিলাম।’


মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেই শিকাগো থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর শেষ ভাষণ দিলেন বারাক ওবামা। এবার ভাষণের স্থান খোলা মাঠ নয়, ২০ হাজার লোকে ঠাসা দেশের সর্ববৃহৎ সম্মেলনকক্ষ। অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁদের বিদায়কালে দেশের মানুষের কাছে ধন্যবাদ জানিয়েছেন হয় চিঠি লিখে অথবা হোয়াইট হাউস থেকে আনুষ্ঠানিক ভাষণ দিয়ে। ওবামা ভিন্ন জাতের রাজনীতিক, মানুষের সঙ্গে করমর্দন ছাড়া, তাঁদের সঙ্গে শেষবারের মতো আরও একবার মুখোমুখি কথা না বলে নীরবে সরে যাবেন, তেমন মানুষ তিনি নন।
প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী ভাষণের সময় ম্যাককরমিক প্লেসের কনভেনশন সেন্টারের প্রত্যেক কৃতজ্ঞ দর্শক চোখের জলে বিদায় জানালেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে রূপান্তরশীল এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে। আবেগ সংবরণ করতে না পেরে অশ্রুসিক্ত হয়েছেন ওবামা নিজেও।
গত আট বছরের শাসনামলের অর্জনের ফিরিস্তি দেওয়ার জন্য এই ভাষণ দেননি ওবামা। শিকাগোর ভাষণে তাঁর লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ওপর যে হুমকি এসেছে, বিপদের যে কালো ছায়া এই দেশের ওপর ভর করেছে, কীভাবে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব, সে কথা বুঝিয়ে বলা।
নির্বাচিত হওয়ার পর ওবামা রাজনীতি ও বর্ণভিত্তিক বিভাজন অতিক্রম করে অবিভক্ত ও অনেক কম বৈষম্যমূলক এক যুক্তরাষ্ট্র নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিদায় নেওয়ার আগে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে পারেননি। দেশ এখনো আগের মতো বিভক্ত, যে বিভক্তির ফলে এই দেশের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা হুমকির সম্মুখীন।
ওবামা তাঁর শাসনের আট বছর পর, যুক্তরাষ্ট্র এখন বসবাসের জন্য অধিকতর যোগ্য—এ কথা বলার পাশাপাশি এই দেশের সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। ওবামা বললেন, ২০০৮ সালে তাঁর নির্বাচনের পর অনেকেই একটি বর্ণবিভাজনহীন আমেরিকার কথা বলেছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবসম্মত ছিল না।
তাই বলে অগ্রগতি হয়নি, সে কথা মানেন না ওবামা। ‘এ কথা বোঝার মতো আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে যে এই দেশের সাদা-কালোর মধ্যে সম্পর্ক এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো, তবে যতটুকু অর্জন চেয়েছিলাম, এখনো তা অর্জিত হয়নি।’
ওবামা তাঁর ভাষণের কোথাও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম উল্লেখ করেননি বা তাঁকে জিততে সাহায্য করা বিভেদাত্মক ও বর্ণবাদী রাজনীতির দিকে আঙুল তোলেননি। কিন্তু এই ভাষণের আগাগোড়া ট্রাম্প তাঁর চিন্তায় ছিল, তাতেও কোনো ভুল নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসীদের প্রতি যে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তার ফল শুভ নয়, ওবামা সে কথাও উল্লেখ করেন। ‘আমাদের মতো দেখতে নয়, শুধু এই কারণে আমরা যদি অভিবাসীদের সন্তানদের জন্য বিনিয়োগে অস্বীকার করি, তাহলে নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎই আমরা বিপদগ্রস্ত করব।’
ওবামার প্রস্থানের পর ক্ষমতা গ্রহণ করবেন যে ট্রাম্প, তিনি তাঁর আট বছরের প্রায় প্রতিটি অর্জন বাতিল করতে বদ্ধপরিকর। দর্শকদের অধিকাংশ ট্রাম্পের প্রসঙ্গ আসামাত্রই দুয়োধ্বনি তুলছিলেন, কিন্তু ওবামা তাঁদের নিরস্ত করেন। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর মার্কিন গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তবে ট্রাম্পের হাতে দেশের গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত হতে পারে, সে আশঙ্কাও তিনি অগ্রাহ্য করেননি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাকে সর্বদা গ্রহণ করেন না, প্রমাণিত তথ্যে তাঁর আস্থা নেই, তাঁর নাম উল্লেখ না করেই সে প্রবণতার বিপদ সম্পর্ক ওবামা হুঁশিয়ার করে দেন।
ট্রাম্পের জয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকদের মধ্যে হতাশা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টির আশঙ্কা মাথায় রেখে ওবামা তাঁদের আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রমের আহ্বান জানান। হিলারির পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল অনেক ভোটারের অনুপস্থিতি—সেদিকে ইঙ্গিত করে তরুণদের উদ্দেশে ওবামা বলেন, ‘ইন্টারনেটে একে অপরের সঙ্গে বিবাদ না করে বাস্তব জীবনে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলো।...তোমরা যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারে এতই হতাশ, তাহলে রাস্তায় নামো, দরকার হলে নিজেরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো।’
ওবামা এখনো এক ইতিবাচক, সম্মুখদর্শী ও আদর্শবাদী যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বাসী, এই ভাষণে সে কথা স্পষ্ট। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে যে হোয়াইট হাউস তিনি রেখে যাচ্ছেন, সেখানে তাঁর আলোকিত যুক্তরাষ্ট্রের কি কোনো স্থান আছে? অনেক হতাশ উদারনৈতিক ভাষ্যকার এমন একটি প্রশ্ন তুলেছেন। দ্য নেশন পত্রিকায় ভাষ্যকার জোয়ান ওয়েলশ মন্তব্য করেছেন, ‘এ কথা ঠিক, ওবামা অনেক পরিবর্তন এনেছেন, কিন্তু তাঁর সে অর্জন ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য ট্রাম্পের মতো একজনই যথেষ্ট।’

Popular posts from this blog

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

The army is torturing the Chakmas of Bangladesh by violating human rights